পৃথিবীতে কঠিন সব প্রশ্নগুলোর একটি হচ্ছে,ভালোবাসা মানে কি?অথচ ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। আমরা ভালোবাসা মানে বুঝি বাবা মা,ভাই-বোন, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু আজ যেহেতু ভালোবাসা দিবস, তাই আজকে আমরা দুটি মানুষের মধ্যকার তথা প্রেমিক যুগলের ভালোবাসা নিয়ে কথা বলবো। এই ভালোবাসা বলতে আমরা হৃদয়ের গহীনের এমন একটা অবস্থাকে বুঝাই যা স্বর্গীয় সুখের চেয়েও তীব্র অনুভূতি জোগাতে সক্ষম!ভালোবাসাকে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন রবী ঠাকুরের মতে-‘সখী ভালোবাসা কারে কয়? সে কি কেবলই যাতনাময়?’
ভালোবাসা যেখানে স্বর্গীয় সুখের চেয়েও তীব্র অনুভূতি জোগাতে সক্ষম, সেখানে রবী ঠাকুরের এমন কথা বলার কারণ কি হতে পারে ভেবেছেন কখনো? অবশ্য এসব নিয়ে ভাবার সময়ই নেই কারও। কেননা এই যুগে এসে ভালোবাসা বলতে বুঝানো হয় ক্যাফেতে বসে ঘনিষ্ঠ হওয়া কিংবা আমরা সুখী তা মানুষের কাছে প্রমাণ করা। কিন্তু ভালোবাসা মানে তো এমন কিছুই নয়। অন্তত আমার এমনই মনে হয়। আমার কাছে ভালোবাসা মানে অতিরিক্ত। এই অতিরিক্ত এর আবার দুইটি ধাপ।
প্রথমত অতিরিক্ত সুখ। যখন নতুন নতুন কেউ কারো প্রেমে পড়ে তখন মনে হয় পৃথিবীর সকল সুখ তার হাতের মুঠোয়। দ্বিতীয়ত হচ্ছে অতিরিক্ত শোক।মানে, যখন কোনো কারণে বিচ্ছেদ হয় তখন নরকীয় দুঃখের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় জীবনটা।
একসময় ভালোবাসা বলতে বুঝানো হতো মনের মিলকে,আর এখন ভালোবাসা মানে লোক দেখানো আত্মতৃপ্তি। একটা সময় ছিলো যখন প্রিয়তম’র একটি চিঠির অপেক্ষায় শত বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছে নির্বোধ, নিষ্পাপ প্রেমিকা। কাজলের পরিবর্তে চোখের নিচে জমেছে কালো আস্তর, যাকে আমরা এখন ডার্ক সার্কেল বলে থাকি। প্রেমিকের একটি চিঠি পাওয়ার অসুখে আক্রান্ত প্রেমিকা এ যুগে নেই। এখন প্রযুক্তির যুগ।যেখানে মেসেঞ্জারে হাই দিয়ে শুরু হওয়া প্রেমের বিচ্ছেদ হয়ে যায় ব্লক নামক একটি অপশনে।
ভালোবাসার মূল্যটা এখন ব্লক, আনব্লকেই সীমাবদ্ধ। এসব ভালোবাসায় প্রেমিকার চোখের নিচের কাজল লেপ্টে যাওয়া দেখার আকুতি জাগে না প্রেমিকের মনে, প্রেমিকার হাতে রেশমি চুড়ির রিনরিন শব্দ শুনে কানের কাছে আর কোনো শিহরিত পরশ জেগে উঠে না। এযুগের ভালোবাসায় নব্বই দশকের মতো অপেক্ষা নেই, পবিত্র অনুভূতি নেই, প্রেমিকের জন্য মন আকুল হওয়ার কোনো বাসনাও নেই। আছে সন্দেহপ্রবণতা, আছে অবিশ্বাস, লোক দেখানো প্রেম ও মিথ্যাবাদিতা।
তবে এতো কিছুর পরও এখনো কিছু প্রেমের সম্পর্ক আছে নির্ভেজাল, তবে তা হাতেগোনা কয়েকটি উদাহরণ। লাইলী মজনু, শিরী-ফরহাদের মতো ভালোবাসা এযুগে নেই। নেই রোমিও জুলিয়েটের মতো ত্যাগ স্বীকারকারী প্রেমের উদাহরণ। আছে শুধু শরীরের প্রতি মোহ।
তাইতো এরউইন শ্রোডিঞ্জার নামক ভদ্রলোক বলেছেন- “Love is the soft version of sexual attraction”। মানে ভালোবাসার সাথে শরীরের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এই সম্পর্কটা যখন আত্মার চাইতেও শরীরে বেশি সীমাবদ্ধ হয়ে যায় তখন সেটা আর ভালোবাসা থাকে না। শরীরের চাহিদা মেটানোর খোরাক হয়ে যায়। দুইটি মানুষের মধ্যে আত্মার সম্পর্ক না থাকলে ভালোবাসার বন্ধন ফিকে হয়ে যায়, বিচ্ছেদ বেড়ে যায়। বিরহব্যথা মাথা নাড়া দিয়ে উঠে।
পরিশেষে বলতে চাই নানা প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার মধ্যেও ভালোবাসারই জয় হোক। ভালোবাসায় পরিপ্লুত, পুষ্পিত হয়ে মানবিক হোক পৃথিবী।